ঘটনা এক
সামনে বসে আছেন শাহেদ ও তনিমা (ছদ্মনাম), তাদের ৫বছরের সংসার জীবন। দুজন এক সাথে এসেছেন কাপল কাউন্সেলিং এর জন্য। পরস্পরের প্রতি অভিযোগ যে দুজনেই #পরকীয়ায় জড়িত (সন্দেহ), তাছাড়া প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া ও মারামারি ঘটনাও ঘটছে। দুজনেই অভিযোগের কিছু অংশ স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সে কি কারণে এমন কাজ করেছে সেটা সে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু কেউ কারো ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়, তাই #ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন একজন আরেকজনকে। ডিভোর্স দেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে #কাপল_কাউন্সেলিং এর জন্য আমার কাছে আসছেন। উল্লেখ্য এই দম্পতির একটি ছেলে সন্তান রয়েছে যার বয়স ৩বছর।
ঘটনা দুই
আফিফা (ছদ্মনাম) একটানা কান্না করে গেলো আমার সামনে। প্রায় ১৫মিনিট ধরে একটি কথাও বলে নি সে। শুধু কেঁদে গেছে, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে সংসার করছে দু বছর হলো, কিন্তু স্বামীর শারীরিক ও #মানসিক_নির্যাতন সে আর সহ্য করতে পারছে না, অন্যদিকে সে কোনমতেই ডিভোর্স নিতে রাজি না। সে চায় একটি সুন্দর গোছানো সংসার, যেখানে স্বামী তাকে ভালোবাসবে আর সে মনোযোগ দিয়ে সংসার করবে। কিন্তু গত দু বছর ধরে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে, কিন্তু কিভাবে বিয়ে টা টিকিয়ে রাখবে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কারণ তার ভয় হলো একবার ডিভোর্স হলে সে জীবনেও সমাজ ও পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না, কেউ তাকে মেনে নিতে পারবে না।
ঘটনা তিন
মারিয়া (ছদ্মনাম) ক্লাস সেভেনে পড়ে, যদিও তার ক্লাস করতে ইচ্ছা করে না। পড়াশুনা তার ভালো লাগে না। ওর বাবা মায়ের অভিযোগ এক মুহুর্ত পড়াশুনা করে না, ক্লাস করে না, সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ঘরে শুয়ে থাকে। অন্যদিকে মারিয়ার ভাষ্য সারাদিন বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি চলে, কখনো মারিয়া কে উদ্দেশ্য করে তার #বাবা_মা চিৎকার করেন, কখনো বাবা মায়ের মধ্যে তীব্র ঝগড়া, এবং চিৎকার চেচামেচি এক পর্যায়ে মারামারি তে পৌঁছায়। ফলাফল সবাই অশান্তি তে থাকছে এবং মারিয়ার চাওয়া সে এই পরিবেশ থেকে পালিয়ে যেতে চায়।
উপরের তিনটা ঘটনায় আমরা চাইলেই খুব #সহজ_সমাধান দিয়ে দিতে পারি, প্রথম দুইটায় ঘটনায় ডিভোর্স দিয়ে দেওয়ার কথা অথবা মানিয়ে চলার কথা বলতে পারি, তৃতীয় ঘটনায় মারিয়া কে বলতে পারি হোস্টেলে চলে যেতে! যেহেতু আমি #সাইকোলজিস্ট তাই এই সহজ সমাধান দিতে পারি নি। শুধু অনুরোধ করেছি, আমরা আগামী দেড় দুই মাস এক সাথে কাজ করি। দুই বা তিন মাস পরে আপনারা যেকোন সিদ্ধান্ত নিবেন তাতে আমার সাপোর্ট পাবেন। উল্লেখ্য প্রফেশনাল হিসেবে সাইকোলজিস্টদের আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয় সেটি হলো ক্লায়েন্ট এর জীবনঘাতী কোন ঝুঁকি আছে কিনা, থাকলে সেটি প্রথমেই নিষ্ক্রিয় করা হয়। যাইহোক, এই দেড় দুই মাস আসলে কি করেছি?
যেকোন মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার প্রধান কারণ আমরা কেউ কারো কথা শুনতে চাই না, শুনলেও অনুভূতি ও চিন্তা বুঝতে চেষ্টা করি না, আর সে অনুযায়ী নিজেদের আচরণ পরিবর্তন আনতে চাই না, আর আমাদের #জাজমেন্টাল#মানসিকতা তো আছেই। তাই আমার প্রথম কাজ ছিল দফায় দফায় এদের সকলের বক্তব্য শোনা, তাদের চিন্তা, অনুভূতি, বিশ্বাস, অতীত অভিজ্ঞতা, শৈশব, কৈশোর সহ জীবনের বিভিন্ন ধাপে হওয়া তাদের নানাবিধ অভিজ্ঞতা বিস্তারিত শোনার ফলে তাদের বর্তমান সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা গেছে, অর্থাৎ তাদের নীডস গুলো কি কি, তাদের নিজেদের #অবচেতন মনে জমা হওয়া দুঃখ, কষ্ট, ট্রমা ও অযৌক্তিক বিশ্বাস ও ধারণাগুলো তুলে আনা হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে পরিবর্তনের কাজ, এইভাবে ধীরে ধীরে প্রতিটা মানুষকে করা হয়েছে ইমোশনালি ইনডিপেনডেন্ট, তাদের চাওয়া পাওয়া গুলো সম্পর্কে করা হয়েছে সচেতন, এবং সর্বশেষ তাদের প্রায়োরিটি ঠিক করতে সাহায্য করা হয়েছে।
তাহলে ফলাফল কি হলো?!
প্রথম ঘটনায় যে দম্পতির কথা বলা হয়েছে উনারা ডিভোর্স নেন নি, বরং উনাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এখন সন্তান সহ স্বাভাবিক (সুখী) জীবনযাপন করছেন। কিছুদিন আগে #ধন্যবাদ দিয়ে বিশাল এক মেসেজ দিয়েছেন।
দ্বিতীয় ঘটনায় যিনি আসছিলেন উনি চেষ্টা করেছিলেন উনার হাজবেন্ড কেও নিয়ে আসার, কিন্তু উনার হাজবেন্ড আসতে চান নি। অফিসিয়ালি সেশন শেষ হওয়ার মাস খানেক পরে উনি জানালেন যে উনি ডিভোর্স নিয়েছেন, আগের তুলনায় এখন উনি #আত্মবিশ্বাসী, উনি জানেন উনার জীবন নিয়ে কোন দিকে আগাতে চান, এবং সম্প্রতি উনার নিজের একটি ইনিশিয়েটিভ শুরু করেছেন। পরিবার সহ নিজের একটি #সাপোর্ট_সিস্টেম তৈরি করেছেন, ফলে উনি একটি স্বাভাবিক জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং এতে উনি খুবই খুশি।
তৃতীয় ঘটনায় যে কিশোরীর কথা বলা হয়েছে সে কিছুদিন আগে মেসেজ করেছে, ভাইয়া আমি এখন অনেক ভালো আছি, আব্বু আম্মুর সম্পর্ক অনেক উন্নতি করেছে, আমার সাথে আম্মুর সম্পর্ক অনেক ভালো হয়েছে। এখন আমার #পড়াশুনা করতেও ভালো লাগে, বাসায় আম্মুর সাথে সময় কাটাতে ও ভালো লাগে। আর এইটা সম্ভব হয়েছে আপনার জন্য, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। (মারিয়া এবং ওর বাবা মা তিনজনই আমাকে ভাইয়া বলে ডাকে )
উপরের ঘটনা ও ফলাফলগুলো কেন শেয়ার করছি? কারণ আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা হচ্ছে সহজেই জাজ করে ফেলা, এবং সে অনুযায়ী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া কিংবা পরামর্শ দেওয়ার নামে নিজের #ব্যক্তিগত জাজমেন্ট দিয়ে দেওয়া যা আদতে ঠিক নয়। কাউকে পরামর্শ দেওয়ার আগে তাদের কথা শুনুন, প্রয়োজনে আলাদা সময় দিন, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরামর্শ যে দিচ্ছেন তার #দায়িত্ব কি আপনি নিচ্ছেন? যদি না নিতে চান তাহলে সমাধান মূলক কোন পরামর্শ না দিয়ে ব্যক্তিকে সাহায্য করুন সিদ্ধান্ত নিতে। যাতে সে নিজে সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে এবং সেই সিদ্ধান্তের #কনসিকয়েন্স যেন মেনে নিয়ে উপভোগ করতে পারে নিজের জীবনটাকে। তাই সাইকোলজিস্টগণ কখনো ডিরেক্ট পরামর্শ বা সমাধান দেন না, আমরা ব্যক্তিকে এমনভাবে তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করি যাতে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, নিজের সম্ভাবনা সম্পর্কে সে জানে এবং ভবিষ্যতেও যাতে সে ভালো থাকতে পারে।
বি: দ্রঃ ১। #সাইকোথেরাপির প্রসেস একটু সময় সাপেক্ষ, তাই চটজলদি আমাদের কাছে কোন সমাধান নেই। অনেকেই খুব দ্রুত ভালো হতে চান কিংবা রিকোভার করতে চান, কিন্তু কোন সাইকোথেরাপি দ্রুত কোন সমাধান দিতে পারে না। #সাইকিয়াট্রিস্ট দের মধ্যে যারা সাইকোথেরাপির উপর বিশদ ট্রেনিং ও পড়াশোনা করেছেন তারাও এইটা মেনে নিতে বাধ্য, তবে যারা করেন নি তারা নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত রোগীকে দিয়ে থাকেন যা কোন মতেই সাইকোথেরাপির অংশ না।
বি: দ্রঃ ২। উপরের কেসগুলো সফল ভাবে শেষ হয়েছে বলে ভাবার কোন কারণ নাই আমি সব কেস সফল ভাবে ডিল করতে পেরেছি, আমার বেশ কিছু কেস রয়েছে #unsolved, সেগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লেখার ইচ্ছা আছে। তবে অধিকাংশ unsolved case এর মূল কারণ হচ্ছে ক্লায়েন্ট দ্রুত সমাধান চান বা রিকভারি করতে চান যা আদতে অসম্ভব, তাই দু তিনটা সেশনের পরে কন্টিনিউ করেন না।
বি: দ্রঃ ৩। আমি সাধারণত বাচ্চা, কিশোর কিশোরীদের নিয়ে কাজ করতে চাই না। কারণ সমস্যা কিশোর কিশোরীদের না, ওদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় দ্রুত, কিন্তু সমস্যা হলো প্যারেন্টদের। তারা দ্রুত রেজাল্ট চান, কিন্তু নিজেরা কোন প্রকার সহযোগিতা করতে চান না। ফলে আমি খুব বিরক্ত হই, যদিও এখন অনেক #প্যারেন্ট খুব সচেতন এবং নিজেদের কে নিয়ে কাজ করেন।
এই লেখার মাধ্যম জানান দিতে চাই যে আমাদের #জাজমেন্টাল_মানসিকতা নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা আসছে, পাশাপশি #রোমান্টিক_সম্পর্কের#আদি_থেকে_অন্ত নিয়ে আরেকটি লেখা প্রক্রিয়াধীন আছে।
OUR BLOG
Read to accelerate your wellbeing
Yes, it’s true Psychotherapy Helps!

DIVORCE AND COMPATIBILITY ISSUES REALITY CHECK FOR COUPLES
