সেনেকা, রোমান দার্শনিক লুকিউস আন্নাউস সেনেকা মূলত পরিচিত স্টয়িকবাদের অনুসারী ও প্রচারের জন্য। তার আরেকটি পরিচয় হল তিনি ছিলেন রোমান সম্রাট নীরু র শিক্ষক। এক রাজকর্মচারীকে লেখা চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত অন দ্যা শর্টনেস অফ লাইফ গ্রন্থে উঠে আসে জীবনের প্রতি সেনেকার দর্শন, উপলব্ধি এবং মন্তব্য।
জীবনকে উপভোগ করার জন্য আমাদের আসলে অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, আমরা চাইলে এখনি করতে পারি। নিজেদেরকে তৈরি করে তারপর উপভোগ করার যে ধারণা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সেনেকা আরো দুই হাজার বছর আগেই। প্রতিটা মুহূর্ত বেচেঁ থাকার জন্য চমৎকার একটা সুযোগ, যেখানে আমাদের অতীত বা ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বর্তমানের যে ক্ষমতা বা সৌন্দর্য্য সেটা পুরোপুরি আস্বাদিত করতে হলে আমাদের মুক্ত হতে হবে অতীতের বোঝা থেকে অথবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা থেকে। বাঁচতে হলে এখনি বাঁচুন, ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করে নয়।
আমাদের জীবন ছোট নয়, কিংবা আমাদের কে বেচেঁ থাকার জন্য কম সময় দেওয়া হয় নি। আমরা অপাত্রে সময় অপচয় করি বলেই মনে হয় আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। তাই নিজের জীবনকে ভালোভাবে বুঝে উঠা টা জরুরি, বিশেষ করে নিজের অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণকে। নিজেকে যত ভালোভাবে বুঝবো আমরা ঠিক ততটাই অন্যকে বুঝতে পারবো, সর্বোপরি মেনে নিতে পারবো নির্দ্বিধায়। আর এই বুঝাবুঝির সর্বশেষ ফলাফল হলো বর্তমান মুহূর্তে নিজের জীবনকে উপভোগ করা, অর্থাৎ যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তখন আমরা সেটা নিতে পারবো।
বর্তমানে মাইন্ডফুলনেস টার্মটা র সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত, বিশেষ করে আমি নিয়মিত প্রফেশনাল ও পার্সোনাল লাইফে এই টার্ম টা ব্যবহার করি। আধুনিক যুগে এসে পশ্চিমে শুরু হলেও বর্তমানে সারা বিশ্বেই মাইন্ডফুলনেস এর কদর বাড়ছে, বিশেষ করে থেরাপিউটিক কর্মকাণ্ডে এর কার্যকারিতা বেশ লক্ষণীয়। যদিও সর্বত্র এর ব্যবহারে নানা ফ্রেমওয়ার্ক, জটিল থেরাপিউটিক পদ্ধতি, কিংবা গুরুত্ব বুঝাতে ভারী ভারী শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা সবসময়ই বেশ সহজ ও সর্বজনীন মনে হয়েছে।
আধুনিক থেরাপিউটিক টেকনিক কিংবা তাত্ত্বিক দিক যদি আমি বাদ দেই, তবে দেখতে পাই সেই আদিকাল থেকেই মানুষের মাঝে আসলে মাইন্ডফুলনেস চর্চা চলে আসছে। প্রতিটা সভ্যতায়, প্রতিটা দর্শনে, প্রতিটা ধর্মীয় অনুশাসনে, প্রতিটা সাহিত্যে কোন না কোন ভাবে উঠে এসেছে কিভাবে বর্তমান মুহূর্তে জীবনকে উপভোগ করা যায় এবং জীবনকে আরো বেশি অর্থপূর্ণ করা যায়। নানা রকম দিকনির্দেশনা থাকলেও মূলত লক্ষ্য একটা ই, নিজের চিন্তা অনুভূতি ও আচরণকে বুঝতে পারা, চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া, বর্তমান কে মেনে নেওয়া কোন প্রকার বিচার না করে, তবেই আমাদের শান্তি মিলবে, সেই সাথে মিলবে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ধারণা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার আত্মবিশ্বাস।
বুদ্ধ দর্শনের শূন্য অনুভব করা কিংবা সেনেকার বর্তমান কে উপভোগ করা, বাউল লালনের সিদ্ধিলাভ, কিংবা সৃষ্টিকর্তার ফানা চাওয়া, সবখানেই যেন কোন এক গুঢ় মন্ত্রে উজ্জীবিত মানব সত্তা মনে প্রাণে চেষ্টা করছে নিজের অতীত কিংবা ভবিষ্যতের বোঝা থেকে মুক্তি লাভ করতে সেই সাথে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে এমন এক নতুন দুনিয়ায় যেখানে অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অথবা শান্তির। আর সেটাই লুকিয়ে আছে বর্তমানের ঠিক এই মুহুর্তের মাঝে, যেটাকে আমরা একেক সময় একেক নামে অভিহিত করার চেষ্টা করছি, গ্লোরীফাই করছি নানা তাত্বিক ও জটিল রহস্য কথা দিয়ে।
অথচ বিষয়টা খুবই সহজ, জীবনকে উপভোগ করতে প্রয়োজন বর্তমান মুহূর্ত সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিজের অনুভূতি, আচরণ ও চিন্তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা, বিষয়গুলোকে কোন বিচার না করে মেনে নেওয়া, সেই সাথে নিজের ও অন্যের অনুভূতির প্রতি সহমর্মী হওয়া। ব্যাস, আপনি পেয়ে যাবেন আপনার করনীয় বা পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ধারণা, সেই সাথে জীবনকে উপভোগ করার মূলমন্ত্র।
মৃত্যুর অপেক্ষা না করে আগে বেচেঁ থাকাটা উপভোগ করুন, জীবন এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ
ফয়সাল আহমেদ রাফি