গত ৯ মাসে দেশে ২০০+ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, এরা যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সেটা অনেকেই বুঝতে পারে নি বা বুঝার চেষ্টাও করে নি। এমনকি আত্মহত্যা করার আগে যদি এদের বাবা-মা বা আপনজনকে আপনি জিজ্ঞেস করতেন যে ‘আপনার সন্তানকে আপনি কেমন চেনেন? তাদের অধিকাংশের উত্তর হতো আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না।’ অথচ এদের অধিকাংশই টের পায় নি তাদের সন্তান বা আপনজন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।
এইখানে যে পয়েন্টটি আমি বুঝাতে চাচ্ছি যখন কেউ দাবি করেন তার কাছের মানুষটিকে উনি কত ভালো চিনেন, তখন অধিকাংশ মানুষ দাবি করেন যে নিজের কাছের মানুষটি সম্পর্কে তার থেকে ভালো কেউ জানেন না, এমনকি কাশি দিলেও বুঝতে পারেন কি চলছে তার মাঝে। আর এই দাবি করার ক্ষেত্রে সব থেকে এগিয়ে বাবা মায়েরা, উনারা দাবি করেন সন্তানের মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন কি চলছে সন্তানের মনের মাঝে। অনেক বাবা মা দাবি করেন তারা নিজ সন্তানকে সব থেকে ভালো চিনেন, কিন্তু দেখা যায় তাদের সন্তানকে চেনার সর্বশেষ ধাপ তার সন্তানের সেই কৈশোর পূর্ববর্তী সময়কার ছবি।
কৈশোর বয়স থেকে মূলত বাবা মায়েদের সাথে আমাদের দুরত্ব তৈরি হতে থাকে। বাবা মা মনে করে তারা সন্তানকে খুব বুঝতে পারছে কিন্তু আদতে সন্তানের জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন! এই ভিন্ন জগতে সন্তানের অনুভূতি, চিন্তা ও আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন সম্পর্কে অধিকাংশ বাবা মা সচেতন থাকেন না যার ফলে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া থাকে হয় নেতিবাচক আর নয়ত নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা। অন্যদিকে সন্তানের মাঝে চলে ভিন্ন এক প্রতিক্রিয়া যেখানে সে বাবা মা বা আশপাশের মানুষের সাথে নিজেকে কানেক্ট করতে পারে না, ফলে একটি অদৃশ্য দুরুত্ব তৈরি হতে থাকে। আর এই ভিন্নতার দুরত্ব আর কখনোই কমে আসে না, বরং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাড়তেই থাকে।
আর দূরুত্বের কারণেই সন্তান বাহিরের সম্পর্কগুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে যেখানে সে নিজেকে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে। এরই ধারাবাহিকতায় যখন জীবনে কোন সঙ্গী আসে তখন মনে হয় সেই মানুষটি আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারছে বা আমি তার সম্পর্কে বুঝতেছি। যতদিন এই বোঝাপড়া থাকে ততদিন সম্পর্ক ভালো থাকে, কিন্তু কোন কারণে যখন দুরত্ব তৈরি হতে শুরু করে তখন এক সময় গিয়ে মনে হয় আমার সঙ্গী কে আমি এখন আর চিনি না, অথচ আমরা হয়তো দীর্ঘদিন একই ছাদের নিচে আছি।
এখন প্রশ্ন হলো বাবা মায়ের কিংবা পার্টনারের কেন এই ভুলটা হয়?
প্রথম কারণ হচ্ছে জাজমেন্ট, অর্থাৎ আমরা নিজেদের নানা অভিজ্ঞতা ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি নিয়ত কাউকে না কাউকে জাজ করি। আর এই জাজমেন্ট প্রবল আকার ধারণ করে যখন সন্তান বা আপনজনের বেলায় আসে। আমরা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি সামনের মানুষটা কেমন হবে বা কি করবে। এই জাজমেন্টটা ভালো প্রভাব বিস্তার করে বিশেষ করে অ্যাটাচমেন্ট তৈরি করতে, কিন্তু যখন কাছের মানুষটি কোন ট্রাঞ্জিশনাল পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যান বা লাইফের কোন ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যান তখন আসলে জাজমেন্ট আমাদের সাহায্য করে না তাকে বুঝতে। অধিকাংশ সন্তান তার বাবা মায়ের কাছে অনেক কিছু লুকায় কারণ সে মনে করে তার বাবা মা তাকে জাজ করবে, অথবা মেনে নিবে না। তেমনি পার্টনারের ভয় থাকে সঙ্গী হয়তো তার অনুভূতি বা চিন্তা কে মেনে নিতে পারবে না।
দ্বিতীয় কারণ থাকে কমিউনিকেশন স্কিলের অভাব, অর্থাৎ নিজের অনুভূতিকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে না পারা এবং অন্যের অনুভূতি কে সম্মান করতে না পারা। আমি একটা কথা প্রায়ই শুনি যে, আমি সবরকম ভাবে বুঝিয়েছি, কিন্তু কাজ হয় না! তখন আমি যোগ করি, আপনি যে যে উপায় জানেন সেভাবে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এমন কিছু স্কিল আছে যা আমাদের শিখতে হয়, বিশেষ করে নিজের অনুভূতিগুলোকে, পাশাপাশি অন্যদের কে। কাউকে আঘাত না করেও নিজের অনুভূতি ও চিন্তা প্রকাশ করা যায়, এইটা আমাদের চর্চা করে শিখতে হয়। তবেই অপর পাশের মানুষটা কে আমরা যেমন ভালোভাবে বুঝতে পারি তেমনি নিজেদের কে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারি।
জাজমেন্ট ও কমিউনিকেশন ইস্যু যদি একজন মানুষ সমাধান করতে পারেন তবে তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। এরপর শুধু নিজেকে জানা হবে তার কাজ। একজন বাবা মা কিংবা সন্তান নিজের সম্পর্কে যত ভালোভাবে জানবে সে তত ভালোভাবে অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে।
তাই মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুতে কাজ করতে হলে প্রথম করণীয় হচ্ছে জাজমেন্ট এর ইমপ্রুভমেন্ট, কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা, এবং নিজের সম্পর্কে এক্সপ্লোর করা যেখানে ট্রমা, অ্যাটাচমেন্ট ইস্যু, ইত্যাদি থাকলে সমাধান করা জরুরি।
পিতামাতা বা সন্তান, পার্টনার অথবা নিজের, সকলের জন্যেই নিজেদেরকে নিয়ে কাজ করাটা জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হলো ক্যান্সারের মত। অল্পতেই যখন কাজ করবেন তখন সেগুলো আর মানসিক রোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে না, উল্টো জীবনমান ও সম্পর্কগুলো উন্নত করতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে অবহেলা করলে এমন একটি অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে যেখানে আসলে পার্মানেন্ট রিকভারি বলে কিছু থাকবে না, যেমন নানা রকম জটিল মানসিক রোগসমূহ। ইদানিং অল্প বয়সে বাচ্চাদের মাঝে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার অথবা বর্ডারলাইন ডিজঅর্ডারের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে যা উদ্বেগজনক। এছাড়াও বাচ্চার হয়তো সামান্য কোন স্পেশাল নিড আছে, সেটা যত দ্রুত স্বীকার করা যাবে তত ভালো ব্যাবস্থা নেওয়া যাবে। কিন্তু অস্বীকার করলে বা ব্যাবস্থা না নিলে সেটি বাচ্চার ভবিষ্যত ঝুঁকি তৈরি করবে।
সুতরাং সন্তানকে বুঝতে হলে নিজেকে আগে বুঝার চেষ্টা করুন, আপনার মাঝে কি কি জাজমেন্ট আছে যা সন্তানের সাথে কমিউনিকেশন করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। সাইকোলজিক্যাল কমিউনিকেশন স্কিল কি আদৌ আছে? যদি না থাকে তাহলে শেখার চেষ্টা করুন। পার্টনার বা সঙ্গীর অনুভূতি কে বুঝার চেষ্টা করুন, তার মাঝে কি চলছে। সন্তান বা আপনজনের জীবনে কি ধরনের সময় পার করছে? ইমোশনাল, চিন্তার কিংবা আচরণের দিক থেকে কি কি পরিবর্তন আসছে সেগুলোকে কোন প্রকার জাজ না করে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন। সেই সাথে নিজের কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করুন যাতে সহমর্মিতার সাথে কানেকশন তৈরি করতে পারেন। এতে দুইজনের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি যেমন কমবে তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বহুলাংশে কোন আসবে। এছাড়াও নিজের ও আপনজনের ট্রমা অ্যাটাচমেন্ট ইস্যু বুঝার চেষ্টা করুন, সেগুলোর জন্য প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টদের সাহায্য নিয়ে কাজ করুন, গাইডলাইন ফলো করুন, তবেই আপনি নিজে যেমন আপনার জীবন কে উপভোগ করতে পারবেন, তেমনি আপনার সম্পর্কগুলো হবে উপভোগ্য এবং আপনজনের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে আসবে নিজেদের অগোচরেই। আর তখনি বলতে পারবেন আপনি নিজেকে অনেক ভালো চিনেন সেই সাথে আপনজনকে ভালো বুঝতে পারেন। তার আগে নয়!
সকলের মানসিক স্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসা জরুরি। বাবা মা সন্তান, জীবনসঙ্গী কিংবা কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, সকলের অনুভূতি সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই সকলেরই অধিকার আছে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। যেকোন মন্তব্য বা প্রশ্নকে স্বাগতম জানাই।
বিনীত
ফয়সাল আহমেদ রাফি
ফাউন্ডার এন্ড চিফ সাইকোলজিস্ট
ফয়সাল রাফি এন্ড এসোসিয়েটস
OUR BLOG
Read to accelerate your wellbeing
Yes, it’s true Psychotherapy Helps!

DIVORCE AND COMPATIBILITY ISSUES REALITY CHECK FOR COUPLES
