শিহাব বহুদিন ধরে জারিনকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে, বিভিন্ন আচরণে কিংবা উপহার দিয়ে (অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে উপহার গ্রহণ করতে হয় জারিনের)। অনেক অনুরোধ করে জারিনকে রাজি করায় তার সাথে টুকটাক কথা বলার জন্য কিন্তু একটি ছেলের মাঝে যে সকল গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকলে ছেলেটিকে জারিন জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করবে তার অধিকাংশই শিহাবের মধ্যে অনুপস্থিত। কিন্তু শিহাব সেটা জানার চেষ্টাও করে না, সে বিশ্বাস করে কোন কিছুর পিছনে লেগে থাকলে সফল হবেই।
ওদিকে গত ছয় মাসে শিহাবের আচরণে জারিন বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব তো শেষ করলই, এমনকি ভদ্রতা করে যে উত্তর বা রিপ্লাই দিতো সেগুলোও বন্ধ করে দিলো। এখন শিহাব বন্ধু মহলে বলে বেড়াতে লাগলো জারিন কতটা খারাপ? কতগুলা ছেলেকে ঘুরিয়ে ছেড়ে দেয়, টাকাওয়ালা ছেলে ছাড়া জারিন কাউকে পাত্তা দেয় না। এমনকি জারিনের চরিত্র নিয়েও কানাঘুষা শুরু করে দিলো, প্রশ্ন তুললো যৌন জীবন এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে। অথচ জারিনের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ কিংবা ব্যক্তিত্ব কেমন সেটা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা শিহাবের নেই বা কখনো জানার চেষ্টাও করে নি। যেটুকু জেনেছে সেটুকুও সম্মান করে নি।
ফলাফল জারিন কে বন্ধু মহলে সাময়িক ভাবে অপদস্ত করা কিন্তু শিহাবের কি হলো? সে আবার নতুন করে মুনিয়ার প্রেমে পড়লো, এইবার সে মুনিয়াকে পটিয়েই ছাড়বে!
উপরের ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি আমাদের সকল বন্ধু মহলে কম বেশি পরিচিত। সরাসরি নিজে না করলেও যারা করে এমন কাজ আর যারা ভুক্তভুগি তাদের কাউকে না কাউকে আপনি চেনেন! শুধু ছেলেরা এমন করে সেটা না, অনেক মেয়েরাও এমন করে। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনের অভিজ্ঞতা শুনেছি, দেখেছি। অনেক অনুরোধ করেছে এক্সপ্লোর করার জন্য, একটু কথা বলার জন্য। যখন কথা বলার পরেও দেখলো মিলছে না, এবং সেটা বলল যে আসলে আমি আগ্রহ পাচ্ছি না তখন সে হয়ে গেলো খারাপ মানুষ! কেন ভাই?!!
দুইটা মানুষ ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ভাবনার, তাদের ব্যক্তিত্ব, রুচি, চাওয়া পাওয়া এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। যদি একান্তই কাউকে ভালো লাগে তবে এক্সপ্লোর করা যেতে পারে তবে সেটা কেবলমাত্র নিজেকে নিরাপদ রেখে তবেই। যেটুকু জানলে একজন মানুষের উপর আস্থা আনা যায় সেটুকু জানার পর তবেই আরো গভীর ভাবে সম্পর্কে জড়ানোর কথা একটা মানুষ ভাবতে পারে। তেমনি যদি কথা বলার একটি পর্যায়ে বুঝতে পারে যে তার চিন্তা ভাবনা কিংবা চাওয়া পাওয়ার সাথে মিলছে না সেক্ষেত্রেও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সরে আসা যায়! এইক্ষেত্রে দুইজন দুইজন সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা থাকে। কিন্তু কোন কারণে হয়তো অপর ব্যক্তিকে আপনার ভালো লাগলো না তার অর্থ এই না যে আপনি বাধ্য তাকে ভালো লাগাতে। তেমনি সেও আপনাকে নিয়ে আগাতে চাচ্ছে না, তার মানে এই নয় যে আপনি তাকে বাধ্য করবেন আপনার জীবনে থাকার জন্য!
সবথেকে বড় কথা যে মানুষটাকে ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেন, শুধু মাত্র আপনার সঙ্গে থাকবে না বলে সে ঘৃণার পাত্র হয়ে গেলো? তাহলে আপনার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা আসলে কোথায় গিয়ে দাড়াল? আর সেই মানুষটার পিছনে এতদিন ঘুরে ঘুরে পাত্তা না পেয়ে এখন নিজেই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন তার সম্পর্কে বাজে ও মিথ্যা কাহিনী, তাহলে সাধারণ মানুষ কি কখনো আপনাকে সম্মান করবে?
যে কাউকে অন্ধভাবে পছন্দ করা, তার প্রেমে পড়া এবং পটানোর চেষ্টা করা ইঙ্গিত করে আপনি কতটা ডেসপারেট ও ইনসিকিউর। আর আপনার এই ডেসপারেট ও ইন্সিকিউর আচরণের জন্য সাফার করে সেই মানুষগুলো যাদের কে আপনি ভালোবাসেন বলে দাবি করেন। সব থেকে বেশি টক্সিক ট্রেইট হলো যখন আপনি এক জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দ্রুত আরেক জায়গায় দৌড় দেন! আমি এমন মানুষও দেখেছি যে একই সার্কেলের ৩-৪ বান্ধবী কে প্রপোজ করছে একই পদ্ধতিতে। তাদের চোখে আপনি শুধু একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষই নন, অনেক ক্ষেত্রে তারা আপনাকে দেখবে চরিত্রহীন হিসেবে। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এমন মানুষ আমাদের আশপাশে অহরহ দেখা যাচ্ছে। এদের জন্য আমার মায়া লাগে যে এরা একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতটা চেষ্টা করছে, কিন্তু পরক্ষণেই সেই মায়া পরিণত হয় বিরক্তিতে যখন দেখি নিজেদের ভালো অনুভূতির জন্য অন্য মানুষের জীবন নরক করে দিচ্ছে।
উপরের আলোচনা করলাম unhealthy behaviour সম্পর্কে। তাহলে হেলদি অ্যাপ্রোচ কি?
যদি কাউকে একান্তই ভালো লাগে আপনি সুন্দর ভাবে তাকে জানাতে পারেন। অবশ্যই আপনাদের দুইজনেরই অধিকার আছে এই প্রস্তাবে না বলার বা সরে আসার। এইখানে আমাদের একটি ভয় কাজ করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার, এইটা খুবই স্বাভাবিক একটি ভয়। আমরা কোনপ্রকার unpleasant feelings পেতে চাই না, তবে একই সাথে এইটাও সত্য প্রতিটা অনুভূতি সমান গুরুত্বপূর্ণ। হোক সেটা unwanted বা pleasant. তাই নিজের কষ্ট হোক কিংবা আনন্দ, দুটোকেই মেনে নিতে হয় এবং নিজের অনুভূতির দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। সেটার জন্য আমরা অন্য কাউকে ব্লেম করতে পারি না।
প্রথমত আমার যাকে ভালো লাগছে তার আগ্রহ আছে কিনা আমাকে জানার সেটা জেনে নিতে হবে! তবেই কথা বলার প্রসংগ আসবে। যদি তার আগ্রহই না থাকে তবে সেক্ষেত্রে এক্সপ্লোর করার প্রশ্নই আসে না। আর যদি আগ্রহ থাকে তবে এক্সপ্লোর করা যেতে পারে যেখানে চিন্তা ভাবনা, ব্যক্তিত্বের নানা দিক উঠে আসবে। যার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিবে।
দুইজন মানুষ কথা বলবে, যদি দুজন দুজনের প্রতি আগ্রহ অনুভব করে তবে এই কথা কন্টিনিউ হবে তারপর হয়তো কোন রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি করার বা কমিটমেন্ট নিয়ে চিন্তা করবে। আর যদি কথা বলার মাঝে একজনেরও যদি মনে হয় সে আসলে যা চাচ্ছে সেটা পাচ্ছে না তবে তার সরে যাওয়ার অধিকার আছে। আর তার সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে আপনিও নিজের জীবন নিয়ে আগাবেন সেটাই স্বাভাবিক। দুইজন মানুষ এক সাথে নাই তার অর্থ এই নয় যে তারা খারাপ মানুষ। এই কথা প্রযোজ্য ব্রেকআপ/ডিভোর্স পরবর্তী জীবনেও। সুতরাং তাকে নিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে বাজে কথা বলার কোন অধিকার আপনার বা আমার নেই।
হ্যাঁ, প্রত্যাখ্যাত বা বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণায় আপনি অনেক বেশি কষ্ট অনুভব করতে পারেন, অনেক নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসতে পারে। সেগুলো ম্যানেজ করার জন্য নানা রকম হেলদি প্র্যাকটিস আছে যেমন অনুভূতির জার্নাল লেখা, মেডিটেশন করা, হেলদি লাইফ স্টাইল তৈরি করা, খুব কাছের ও বিশ্বস্ত দু একজনের কাছে শেয়ার করা যাতে আপনার কষ্টটা লাঘব হয়। কিন্তু কোনভাবেই আপনি আরেকজন মানুষের চরিত্র হনন করতে পারেন না। যদি করেন তবে সেটার জন্য অপর পাশের ব্যক্তি লিগ্যাল ব্যবস্থাও নিতে পারেন আপনার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ বলবো নিজের মাঝে থাকা ডেসপারেটনেস এবং ইন্সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করুন, প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট এর সাথে কথা বলে এইসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য কাটিয়ে উঠুন এবং একটি আত্মবিশ্বাসী ও ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলুন। আপনার জন্য শুভ কামনা।
ধন্যবাদ
ফয়সাল আহমেদ রাফি
১০/০৭/২০২২ | ঢাকা, বাংলাদেশ
বিশেষ সংযোজন এক: “কাউকে পটানো” কনসেপ্টটা আমার কাছে ভীষণ আপত্তিকর লাগে। এইটা হলো ডিরেক্ট ম্যানিপুলেট করার লাইসেন্স, অর্থাৎ আরেকজন মানুষের পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী আচরণ করে তাকে মুগ্ধ করছি আদতে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ। যেহেতু অমুককে পটাতে হবে তাই নিজের ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে লুকিয়ে শুধু অমুক মানুষের প্রেফারেন্স অনুযায়ী নিজেকে প্রেজেন্ট করছি যা একই সাথে হিপোক্রেসি এবং ভয়ংকর। ভয়ংকর বলছি এই কারণে যে আপনার এই পটানো আচরণ সমুহ বেশি দিন ধরে রাখতে পারবেন না, পরবর্তী জীবনে আপনাদের মাঝে শুধু কনফ্লিক্ট আর অশান্তি বিরাজ করবে যা শুধু এই দুইজন মানুষের না, বরং অনাগত সকল মানুষের লাইফ অতিষ্ঠ করে তুলবে। সুতরাং পটানো থেকে দূরে থাকুন, নিজেকে নিয়ে ট্রান্সপারেন্ট থাকার চেষ্টা করুন।
বিশেষ সংযোজন দুই: কাউকে প্রপোজ করা বা ভালো লাগার আগে সে মানুষটাকে অন্তত জানার চেষ্টা করুন। তার ব্যক্তিত্ব, পছন্দ অপছন্দের খোজ খবর নিন। যদি মনে করেন আপনার সাথে যাচ্ছে তবেই নিজের মনের কথা প্রকাশ করুন। একই সাথে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্য। কেউ আপনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছে তার অর্থ এই নয় যে আপনি ছোট হয়ে গেছেন বা আপনার যোগ্যতা কমে গেছে। হয়ত ওই মানুষটার প্রেফারেন্স অনুযায়ী আপনি ফিট করছেন না, তেমনি অনেকেই আছেন যারা আপনার পছন্দের ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী ফিট করছে না তার অর্থ এই নয় যে তারাও অযোগ্য। তাই সবক্ষেত্রেই মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন।
বিশেষ সংযোজন তিন: আপনার বহুচারী মন কে বুঝার চেষ্টা করুন, আপনার চাওয়া পাওয়াগুলো কে আরো স্পেসিফিক করুন, একই সাথে নিজের অতীতের ট্রমা, বা মেন্টাল হেলথ ইস্যু থাকলে সেগুলো সমাধান করুন। সর্বোপরি আপনার লাইফ স্টাইল এবং কোয়ালিটি অফ লাইফ উন্নত করুন। কেননা আমরা সবসময় এমন মানুষের সাথে থাকতে চাই যে জীবনটা উপভোগ করছে। আপনি নিজের জীবনকে উপভোগ করতে শুরু করুন, বাকিটা নিয়ে আর অত ভাবতে হবে না।
ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।
বিনীত
ফয়সাল আহমেদ রাফি ফাউন্ডার এন্ড চিফ সাইকোলজিস্ট
ফয়সাল রাফি এন্ড এসোসিয়েটস