বিবাহিত সম্পর্কে জটিলতা ও আমার করণীয়
প্রশ্ন সংক্ষেপঃ
আমার ৬ বছরের প্রেম ও বিয়ের ৩ বছর, এই ৯ বছরের সম্পর্কে ধীরে ধীরে সত্য লুকানো, অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্তবোধ করা, নিজে কিছু (জব/কাজ) করতে না পারা, রোমান্টিক সম্পর্কের অবনতি সহ নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছিলো যা এখন কঠিন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এমন একটি অবস্থায় অন্য একটি মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে যেখানে আমি অনেক ভালো ফিল করি, মনে হয় সেখানে ভালো থাকবো। অন্যদিকে আমার ফ্যামিলি ও স্বামী চাচ্ছে যাতে এখন বাচ্চা নিয়ে নেই, কিন্তু এই রকম ফাইনান্সিয়াল ও মানসিক অবস্থায় আমি বাচ্চা নিতে চাচ্ছি না।
এখন আমি বুঝতে পারছি না কোন কাজটি করলে ভালো হবে? আমি কি নতুন মানুষের সাথে মুভ অন করবো নাকি হাজবেন্ডের সাথে থেকে বাচ্চা নিবো ও সংসার করবো। আমি এখন কি করবো?
প্রশ্নকারী একজন নারী, বয়স দেওয়া ছিল না, থাকেন মফস্বলে স্বামীর সাথে।
আমার উত্তরঃ
আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। দীর্ঘদিন ধরে কঠিন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে পার করছেন যা খুবই উদ্বেগজনক। এতদিন ধৈর্য্য ধরে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন যা সত্যি প্রশংসনীয়। এই অবস্থায় এসে আপনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন যার প্রক্রিয়া ও পরিণতি দুটোই আপনাকে বেশ স্ট্রেস দিচ্ছে বা দিবে। সুতরাং এই সময়টা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেশনাল হিসেবে আমি সবসময় একটা কথা বলি যে এখনি কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে। হোক সেটা নতুন মানুষের সাথে মুভ অন করা অথবা হাজবেন্ডের সাথে থেকে বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। কারণ দুটো সিদ্ধান্তই বেশ কঠিন, বিশেষ করে আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় আমি বলি যে কিছুদিন ব্রেক নিয়ে নিজের উপর ফোকাস করার জন্য। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টা আরো কিছুদিন পরে নিন। এই কিছুদিন নিজেকে নিয়ে একটু কাজ করুন, আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, আপনার নিজস্ব ক্যারিয়ার ও সম্ভাবনা, এবং আরো অন্যান্য দিক যা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কি কারণে বলছি এই কথা:
আমরা যখন দীর্ঘদিন স্ট্রেস, নেতিবাচক পরিবেশ, এবং অন্যান্য ঝামেলায় থাকি তখন আমাদের যৌক্তিক চিন্তা করার সম্ভাবনা কমে যায় ফলে আমরা নির্ভর করি অন্যান্য ফ্যাক্টরের উপর যেগুলো তে আমাদের কন্ট্রোল নেই। যেমন ধরুন আপনার ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত আর্থিক সক্ষমতা এতদিন ধরে নির্ভর করছে আপনার স্বামীর উপর, যদি আপনি আরেকজনের সাথে মুভ অন করেন তখন সেটা নির্ভর করবে তার উপর। অথচ আমরা যদি ফোকাস করি আপনার উপর, তাহলে দেখব আপনি কয়েক মাস বা আরেকটু সময় নিয়ে নিজেকে স্কিলড হিসেবে গড়ে তুললে কারও উপরই আপনার নির্ভরশীল হতে হবে না। বরং আপনার নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
তেমনি ভাবে আপনার অনুভূতিগুলোর দিকে একটু মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে অনেকদিন ধরেই অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা, বঞ্চিত মনোভাব রয়েছে যা আপনাকে প্রতিনিয়ত কঠিন সময়ের মুখোমুখি করিয়ে দিচ্ছে। সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপনি যখন আরেকজন মানুষের উপর নির্ভর করবেন তখনও কিন্তু বিষয়টা আপনার হাতে আসবে না, উল্টো আপনার এই unresolved issues ভবিষ্যত সম্পর্ক, ক্যারিয়ার, সন্তান পালন ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অবচেতন মনেই প্রভাব ফেলতে শুরু করবে যা আপনার জন্য পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল করে তুলবে।
এমন অবস্থায় কোন মেজর সিদ্ধান্ত না নিয়ে আপনি নিজেকে এক্সপ্লোর করতে শুরু করুন, আপনার মৌলিক চাহিদাগুলো কি কি, আপনার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড কি, আপনার ইতিবাচক গুণগুলো কি কি, কোন কোন দিক আপনার আরো উন্নত করার দরকার আছে সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করুন। আপনার লেখা পড়ে মনে হয়েছে আপনি চমৎকার গুছিয়ে লিখতে পারেন, অর্থাৎ আপনি চিন্তাও করতে পারেন গুছিয়ে। সুতরাং আপনি যদি নিজেকে নিয়ে কিছুদিন সময় দেন তাহলে অবশ্যই এই পরিস্থিতে আপনার করণীয়গুলো ঠিক করতে পারবেন।
আর এই অস্থির সময়ে নিজের উপর ফোকাস করতে প্রয়োজন মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস, অর্থাৎ বর্তমানে থাকার প্রবণতা। আপনি ছোট ছোট মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন এর ভিডিও দেখে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে পারেন যা আপনাকে শান্ত করতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন নিয়মিত প্র্যাকটিস করবেন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে গুছানোর বা রিবিল্ড করার পরিকল্পনা করবেন।
আপনি যখনি ইমোশনালি, ফাইন্যান্সিয়ালি, এবং পেশাগত ভাবে ইনডিপেনডেন্ট হবেন এবং আত্মবিশ্বাসী হবেন তখনই আপনি নিজের পরিবার/সন্তান/পার্টনার/নিজের ভবিষ্যত বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। প্রয়োজনে প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টদের সাহায্য নিন, এই গ্রুপে আরো স্বেচ্ছাসেবক আছেন তাদের সাহায্য নিন, তবুও অনুরোধ করবো নিজেকে নিয়ে কাজ করুন।
সংযুক্তি:
এইটা খুবই স্বাভাবিক যে আমরা যখন কারো জন্যে নিজের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দেই কিন্তু অন্যপাশ থেকে তেমন কোন আগ্রহ বা অ্যাপ্রিসিয়েশন দেখি না তখন আমাদের কষ্ট লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এই অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে এবং নিজে স্পেশাল ফিল না করলে সেই সম্পর্কে থাকা ও উপভোগ করা আরো কঠিন হয়ে উঠে। সুতরাং আপনার জন্য বিষয়টা আসলেই অনেক কঠিন।
দ্বিতীয়ত আপনি যে কারণে লো ফিল করছেন সেখানে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করছে:
এক যেহেতু আপনি দীর্ঘদিন ধরেই স্ট্রেস ও স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাই অন্যের আগমনে আপনি যে আনন্দ বা ভালোবাসা অনুভব করছেন সেটা মেনে নিতে অনেক সময় আমাদের অবচেতন মন সায় দেয় না, উল্টো ভয় ও গিল্ট ফিল কাজ করে।
দুই যেহেতু নিজের পার্টনার ব্যতীত অন্য একজন মানুষের প্রতি আপনি ইমোশনালি কানেকটেড ফিল করছেন সেটা সামাজিক, পারিবারিক, এমনকি আপনার নিজস্ব মূল্যবোধের সাথে হয়ত কিছুটা কনফ্লিক্ট করছে (এইটা আমি ধারণা করছি, হয়ত বিস্তারিত ইন্টারভিউ করলে কনফার্ম হতে পারবো)। আর যেকোন ধরনের মূল্যবোধ বা বিশ্বাস সংক্রান্ত কনফ্লিক্ট আমাদেরকে অনেক ডাউন ফিল করায় যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু এইগুলো মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়।
এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে আমার মধ্যে যে অনুভূতিগুলো হচ্ছে সেগুলোকে কোন প্রকার জাজ না করে মেনে নেওয়া। কারণ নিজের অনুভূতি যা হচ্ছে সেটাই এই মুহূর্তে সত্যি, বাকিসব জাজমেন্ট সেকেন্ডারি, তাই অনুভূতিগুলো মেনে নিয়ে তারপর নিজেকে নিয়ে কাজ করা শুরু করুন।
আর নিজেকে নিয়ে কাজ করা বা ফোকাস করা বলতে প্রচলিত সমাজে যা বুঝায় অর্থাৎ নিজের ভালো লাগার কিছু করা বা এ জাতীয় কিছু কে আমি বুঝাচ্ছি না। আমি নিজের উপর ফোকাস করা বলতে বুঝিয়েছি আপনার ইমোশনাল রিকভারি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করা। এবং এইটা একটু সময় সাপেক্ষ, তাই আরেকটু চেষ্টা করুন নিজের সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করার এবং নিজের গোল সেট করুন যাতে ধীরে ধীরে আপনি নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের উপর ভরসা করতে পারেন এবং সেই সাথে নিজের জীবন কে যাতে উপভোগ করতে পারেন।
আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো!
ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।
বিনীত
ফয়সাল আহমেদ রাফি ফাউন্ডার এন্ড চিফ সাইকোলজিস্ট
ফয়সাল রাফি এন্ড এসোসিয়েটস