আপনার বয়স কি ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে? কিংবা পরিবার ও পরিচিত মহলে এই বয়সের কেউ আছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই বয়সের মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা।
প্রথম কারণটি কি জানেন?
উত্তর: দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বুঝতে পারবেন কি পরিমান দুর্ঘটনা ঘটছে এবং তাতে শিক্ষার্থী ও তরুণদের মৃত্যুর ঝুঁকি কত বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বুয়েট এক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার এর ভাষ্য মতে বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১২০০০ হাজার মানুষ মারা যায়। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, অন্যান্য দুর্ঘটনায় তরুণদের মৃত্যুর মিছিল যেন বাড়ছেই যার সর্বশেষ সংযোজন মাঈনউদ্দিন দুর্জয় নামের সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী এক তরুণ। আর দুর্ঘটনার কারণে ট্রমার শিকার লাখ লাখ মানুষ। অন্যদিকে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজারের বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যা করোনাকালীন এক বছরে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার যার অধিকাংশ করে থাকে তরুণদের একটি অংশ।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও প্রতিবাদ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, সেই সাথে সরকার ও সিস্টেম উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে যদিও আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে তরুণদের মাঝে হতাশা ও আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়েই যাচ্ছে নানা কারণে। আমি যেহেতু সাইকোলজিস্ট, তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে ১৫-২৯ বছর বয়সের তরুণদের করনীয় একটি কাজ সম্পর্কে বলছি।
যেকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী কিংবা প্রফেশনাল যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ এর মধ্যে তাদের প্রতি একটা অনুরোধ, যদি নিজের প্রতিষ্ঠানে কিংবা কাছের কোথাও সুযোগ থাকে তবে অবশ্যই কাউন্সেলিং ও থেরাপি সেশন নিয়ে নিজের অতীতের ট্রমা ও অন্যান্য মেন্টাল হেলথ ইস্যু সলভ করবেন, একই সাথে ভবিষ্যতের জন্য রোমান্টিক সম্পর্ক, ক্যারিয়ার ও অন্যান্য মেজর পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুগুলো যাতে সুন্দর ভাবে ডিল করতে পারেন কিংবা নিত্যদিনকার স্ট্রেস ও ক্রাইসিস যাতে ম্যানেজ করতে পারেন সে সম্পর্কিত সাইকোলজিক্যাল দক্ষতাগুলো শিখে নিবেন।
এই সময়টায় যদি আপনি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারেন তবে সারাজীবন এইটার সুবিধা ভোগ করবেন। অন্যথায় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম ক্রাইসিস ফেস করতে গিয়ে ভেঙে পড়বেন যা শুধু নিজের জন্য না, আপনার পার্টনার ও পরিবারের জন্যেও হুমকি স্বরূপ। তাই নিজে ভালো থাকার জন্য এবং অন্যান্যদের জীবনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে তরুণ বয়সেই প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করুন। এমনকি আপনি যদি মনে করেন আপনি মানসিক ভাবে ঠিক আছেন তারপরেও বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণ করুন। নিজের মাঝে সাইকোসোশ্যাল দক্ষতাগুলো তৈরি করুন যাতে ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি যথাযথ ভাবে ম্যানেজ করতে পারেন।
এখন অনেক প্ল্যাটফর্ম আছে যেখানে ফ্রী থেরাপি সেশন দেওয়া হয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিস্ট আছেন, অনেক স্কুল ও কলেজেও সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিচ্ছে। নিজের প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট থাকলে সেখান থেকে ফ্রীতেই থেরাপি নিতে পারবেন, আর যদি সে সুযোগ না থাকে তবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস নিতে পারেন যেখানে অল্প ফি দিয়ে সার্ভিস পাবেন। শুধু প্রয়োজন একটু খুঁজে বের করা, কেননা বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুল হলেও গত ১০ বছরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে যারা স্বল্প মূল্যে কিংবা বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে।
কেন এই বয়সে নিতে বলছি সেটা এখন ব্যাখ্যা করছি।
১৮/১৯ বছর বয়সের পরে একজন মানুষ লিগ্যালি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে থেরাপি সেশন নেওয়ার জন্য। সুতরাং সে চাইলেই এই সাপোর্ট খুজে নিতে পারে, এর জন্যে বাবা মা বা অন্য কারো অনুমতির দরকার হবে না। বিশেষ করে যদি সাপোর্টটা নিজের প্রতিষ্ঠানেই থাকে। তবে ১৫-১৭ বছর বয়সীদের জন্য হয়তো অভিভাবকের সহায়তা লাগবে যদি নিজের প্রতিষ্ঠানে সাপোর্ট না থাকে। এই সময়টায় সে তার শৈশব, কৈশোর পার করে সদ্য তারুণ্যে পদার্পণ করেছে, সুতরাং পূর্বের সকল প্রকার ট্রমা বা অন্যান্য মেন্টাল হেলথ ইস্যু সলভ করা জরুরি নতুন এই পরিবর্তন কে উপভোগ করার জন্য। তেমনি ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার একটি চমৎকার সুযোগ। এই সুযোগে নিজের ব্যাক্তিত্ব শেপ করা এবং কাঙ্ক্ষিত হেলদি আচরণ ও অভ্যাসগুলো তৈরি করার সুযোগ রয়েছে যা তাকে সাহায্য করবে আগামীদিনের জন্য।
যেহেতু এই বয়সে বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাই আমরা , তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমরা নানা রকম মানসিক চাপে থাকি। ফলে অনেকেই ভেঙে পড়ি। যার দরুণ কেউ পড়াশুনায় পিছিয়ে যাই, কেউ পরিবার ও রোমান্টিক পার্টনারের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারি না, কেউ ক্যারিয়ার ও ফিউচারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি না। ফলে নানা রকম মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়, যেমন depression, anxiety, panic attack, obsessive compulsive disorder সহ নানা রকম মানসিক স্বাস্থ্য জটিলতা সামনে চলে আসে যা হয়ত অনেক আগে থেকেই সুপ্তাবস্থায় ছিল কিন্তু এই সময়ে এসে সেটা প্রকট আকার ধারণ করে। এমনকি আত্মহত্যা করে বসতে পারে একজন মানুষ। আর এই বয়সে ঘটনাগুলোর প্রভাব আমরা সারাজীবন বহন করি, তাই এক্সট্রা কারিকুলামের পাশাপাশি নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
সকল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজন সর্বাত্মক সম্মিলিত চেষ্টা ও সদিচ্ছা। যদিও বলছি দুর্ঘটনা, কিন্তু চেষ্টা করলে আমরা এই দুর্ঘটনাও কমিয়ে আনতে পারি ক্রমান্বয়ে। একই কথা প্রযোজ্য তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রফেশনালসহ সকল অংশের সমান অংশগ্রহণেই সম্ভব তরুণদের জন্য একটি নিরাপদ ব্যাবস্থা তৈরি করা যাতে আর একটি মানুষেরও আত্মহত্যা করতে না হয়।
যেহেতু রাষ্ট্র তরুণদের সর্বাত্মক নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সেহেতু নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে হবে। মূলত এই কারণেই ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলন ইস্যুসহ অন্যান্য ইস্যুতে রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে। অন্যদিকে বড়দের কথা বলার সব রাস্তা তো আগেই বন্ধ। তবে একটি রাষ্ট্রের তরুণদের এমন ঝুকির মধ্যে রেখে তাদের কাছে থেকে রিটার্ন পাওয়ার আশা করা কতটুকু উচিত সেটা আমার ছোট মাথায় আসে না। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানের প্রতিটা স্তরে তরুণদের জন্য শুধু হতাশাজনক নানা উপাদান যার ফলে তারা বহির্মুখী হচ্ছে, একবার দেশের বাইরে চলে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। ১৫-২৯ বছর বয়সের তরুণদের নিরাপত্তা, উন্নত শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য্য যদি সে সত্যিকার অর্থেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায়।
যেহেতু কেউ আমাদের দায়িত্ব নিবে না, তাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন শুরু করতে হবে এই সময় থেকেই। ১৫-২৯ বছর বয়সের মধ্যে থেরাপি সেশন নেওয়া হতে পারে আপনার জীবনের সেরা একটি সিদ্ধান্ত। তেমনি যারা পিতামাতা আছেন তাদের জন্য হতে পারে সেরা একটি ইনভেস্টমেন্ট।
ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।
বিনীত
ফয়সাল আহমেদ রাফি ফাউন্ডার এন্ড চিফ সাইকোলজিস্ট
ফয়সাল রাফি এন্ড এসোসিয়েটস