সম্পর্ক, পরকীয়া ও পরিণতি

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: লেখাটি ব্যক্তিগত নৈতিকতার নানা বিধিবিধান দ্বারা বায়াসড।

বেশ কিছুদিন ধরেই পরকীয়া ইস্যুটা বেশ সরব বিভিন্ন সংবাদ ও তারকাদের কারণে। অবশ্য সভ্যতার আদিযুগে অর্থাৎ বিয়ে বা সম্পর্কের সূত্রপাত যখন হয়েছিল তখন থেকেই পরকীয়া ইস্যুটা স্বগর্বে জানান দিয়ে আসছে, কখনো প্রকাশ্যে, কখনোবা গোপনে, কখনো নিজেদের অজান্তেই।

পরকীয়া কাকে বলে? দুইজন মানুষ যখন একটি কমিটেড সম্পর্কে থাকে এবং সেখানে একজন সঙ্গীকে না জানিয়ে অন্য কারও সাথে নতুন সম্পর্কে জড়ায় তখন সেটাকে পরকীয়া বলতে পারি আমরা। একটা সময় শুধুমাত্র বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কগুলোকে আমাদের সমাজে পরকীয়া বলে সজ্ঞায়িত করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে কমিটেড সম্পর্কগুলোর ধরণ পাল্টেছে, যেমন এখন আর শুধু বিয়ের মধ্যেই কমিটেড সম্পর্কগুলো সীমাবদ্ধ না। এখন আমরা দেখতে পাই কৈশোর থেকে শুরু করে যেকোন সময় আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে যেতে পারি, কেউ প্রেম ভালোবাসায় আবদ্ধ, কেউ লিভ টুগেদার করছে, কেউ বিয়ে করছে, আবার যেসকল সম্পর্কের মাঝে বিয়ে করতে আইনগত বাধা নিষেধ আছে সেগুলোও কিন্তু কমিটেড সম্পর্কের আওতায় আসবে যেমন LGBTQ community এর সদস্যগন যাদের বিয়ে কিছু দেশে বৈধ আবার কিছু দেশে অবৈধ, সেক্ষেত্রে তারা কমিটেড সম্পর্কের মাঝেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে। তো এই বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কগুলোতে মূলত যে চাওয়াটা থাকে সেটি হলো সঙ্গী যেন বিশ্বস্ত থাকে এবং তাদের মাঝে ভালোবাসার চর্চা টা যেন থাকে। যদি বহুগামী সঙ্গী থাকে তবে সেটা ভিন্ন কথা, সে নিজের সঙ্গী কে জানিয়েই তৃতীয় কোন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারে সেক্ষেত্রে তার সঙ্গী সেটা মেনে নিতে পারবে কিনা সেটার তার সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে কোনভাবেই বাধ্য করতে পারে না বহুগামী সঙ্গীকে একগামী করে রাখতে কিংবা একগামী সঙ্গীকে বহুগামী হতে।

যাইহোক, আমাদের দেশে আমরা সুবিধামত সব অলিখিত নিয়ম কানুন তৈরি করে নেই। এক সাথে দু চারজনের সাথে প্রেম করলে সেটা হয় এক্সপ্লোরেশন, আর বিয়ের পর সঙ্গী ছাড়া অন্য কারো সাথে হেসে কথা বললেও মনে হয় অনিরাপদ। অথচ যখনি আপনি কমিটেড সম্পর্কে যাবেন তখনি আসলে আপনি অন্যকোন ব্যক্তির সাথে রোমান্টিক সম্পর্কের দিক এক্সপ্লোর করতে পারেন না, যদি করেন তবে সেটা পরকীয়া বলেই ধরা হবে বলে আমার মতামত।

ছোটবেলা থেকে আশপাশের কিছু মানুষের সম্পর্কে এমন কথা শুনতাম, বিশেষ করে আমরা যারা 90s kids বলে দাবি করি তারা মোটামুটি সবাই নিজেদের সিনিয়র বা সমবয়সী ছেলে বা মেয়েদেরকে সম্পর্কে পরকীয়া সংক্রান্ত অনেক মুখরোচক গল্প শুনেছে। কে কতজনের সাথে প্রেম করে, কতজন কে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, কে কত খারাপ, বিয়ের আগে কেমন, বিয়ের পরে কেমন হইলো ইত্যাদি ইস্যু বিভিন্ন আড্ডা আলোচনায় উঠে আসতো। বরাবরই আমি এই ধরনের আচরণ অপছন্দ করতাম, অন্যায় মনে করতাম এবং এখনো সেটা মনে করি। কিন্তু আশেপাশের মানুষের সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মতামত শুনে মনে হলো আমারও মত প্রকাশ করা জরুরি। কারণ এই ইস্যুটা নিরাপদ, এই বিষয়ে মত প্রকাশ করলে সরকারও আমাকে কিছু বলবে না।

যাইহোক, মানুষ প্রাণী হিসেবে মূলত বহুগামী নাকি একগামী সেটা গবেষণার বিষয়। সেই গবেষণায় না গিয়ে আধুনিক কালে মানুষ কি কারণে নিজেদের রোমান্টিক সম্পর্কগুলো কে নষ্ট করছে হোক সেটা বিবাহিত অথবা অবিবাহিত সেগুলোর কারণ অনুসন্ধান করা যাক। পরকীয়া প্রায় প্রতিটা দেশে, সংস্কৃতিতে রয়েছে, কোন অঞ্চলই এর বাইরে যেতে পারে নাই। কিন্তু এই ইস্যুতে কে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে সেটা বেশ লক্ষণীয়। কেউ খুব কঠোর, কেউ খুব নমনীয়, কেউ ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে বিষয়টা কে একান্ত ব্যক্তিগত মনে করে। ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ নানা ফ্যাক্টরের প্রভাবের কারণে এই ধারণাগুলো তৈরি হয়। যে অঞ্চলে ধর্মের প্রভাব বেশি সেখানে যেমন এক রকম, তেমনি যেখানে শিল্প সাহিত্যের চর্চা হয় সেখানে আরেক রকম। এর মধ্যে মজার হলো ফ্রেঞ্চ বা ফরাসিরা।

সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা চরিত্র পরিচয় গল্পে পরকীয়া নিয়ে ফ্রেঞ্চদের ভাবনা সম্পর্কে বলেন, ফ্রেঞ্চরা খুবই উদার প্রকৃতির। তারা প্রেমে অদ্বিতীয়। পরকীয়ার বেলায় ফ্রেঞ্চদের বক্তব্য হলো ফষ্টিনষ্টি করো কোন আপত্তি নাই, কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে তো করো। তো কি সে নিয়ম? নিয়ম হলো ফষ্টিনষ্টি (পরকীয়া) করা উচিত বিয়ের পরে, আগে নয়। যতজনের সাথে ইচ্ছা করো কিন্তু তোমার পরকীয়ার কারণে যদি তোমার মূল সম্পর্ক বা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় তবে নাগর নাগরী দুইজনই সরে যাবেন পরকীয়া থেকে, কেননা তাদের কাছে পরিবার বা মূল সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশেও এমন উদ্ভট বেশ কিছু অলিখিত নিয়ম কানুন চালু আছে, অর্থাৎ তুমি যদি টক্সিক সম্পর্কে বা ম্যারিটাল লাইফে থাকো তবে তোমার জন্য পরকীয়া জায়েজ! কেন এই কথা বলছি?! আপনি সোশ্যাল মিডিয়া, নিজের কাছের বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনদের পরকীয়ার কাহিনী শুনলে দেখবেন মূল কাহিনী বলার আগে তারা কনটেক্সট বলে নেয়, যে তাদের আগের পার্টনার কতটা জঘন্য ছিল, কত কত শারীরিক, মানসিক ও যৌণ অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, তাই সে বাধ্য হয়ে পরকীয়া করেছে। অবশ্যই যেকোন অত্যাচার করা অন্যায় এবং সেটার জন্য প্রতিবাদ ও প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু সে সম্পর্কে কেন ছিলেন? এই প্রশ্ন করলে মোটামুটি সবার একটা কমন উত্তর: পরিবার ও সমাজের ভয়ে! লোকলজ্জার ভয়ে তারা ডিভোর্স বা বিচ্ছেদ করতে পারেন নি।

Curious mind wants to know: যে সমাজ ও পরিবারের কথা বলছেন তারা কি আপনার পরকীয়াকে সাপোর্ট করছিল বা এখনো করে? কোন সমাজে পরকীয়া করলে পুরষ্কৃত করে? অন্যদিকে এই সমাজ বা লোকজন কিন্তু আপনার টক্সিক সম্পর্ক থেকে বের হইতে সাহায্য করছে না, বরং আরো জোর দিচ্ছে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যা খুবই আপত্তিকর। আমি কখনোই একজন মানুষকে কোন টক্সিক সম্পর্কে থাকার জন্য উৎসাহিত করতে পারি না। এই জন্য যারা সাহস করে টক্সিক বা নির্যাতনের শিকার সম্পর্কগুলো তে বিচ্ছেদ করছেন, বা সরে আসছেন তাদের কে আমি বাহবা দেই।

তবে সবথেকে সুশীল যে মন্তব্যটা শোনা যায় সেটা হলো আমরা সবার কনটেক্সট জানি না, না জেনে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। অর্থাৎ আমি যদি কনটেক্সট জানি তাহলে সেটা জায়েজ হয়ে যাবে?! যেমন একজন সিরিয়াল কিলার নিজের প্লেজারের জন্য মানুষ খুন করে, আমরা যেহেতু জানি না তার ছোটবেলায় কোন ট্রমা ছিল কিনা, তার বাবা মা এবিউজিব ছিল কিনা, বিভিন্ন সময়ে সে কোন অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়েছিল কিনা, তাকে কেউ ম্যানিপুলেট করেছিল কিনা! যদি সে এইসবের মধ্যে দিয়ে যেয়ে থাকে তবে তার খুন করাটা জায়েজ?! কারণ সে তো সুস্থ পরিবেশে বড় হয় নাই.। অন্য দিকে যে মানুষ টা খুন হলো তারে নিয়ে আপনার আমার মাথা ব্যথা নাই, কারণ তার কোন কনটেক্সট নাই, তার যে স্বপ্ন ছিল সেটা তার সাথেই মরে গেছে, এখন বডি টা মাটি চাপা দিতে পারলেই বাঁচি, নাকি? ভ্যালিড কনটেক্সট থাকলেই কোন অন্যায় ন্যায় হয়ে যায় না, হয়তো পানিশমেন্ট একটু কম বেশি হইতে পারে কিন্তু অন্যায় টা অন্যায়, জুলুম সব সময়ই জুলুম। আমি যদি কারো গায়ে হাত তুলি তবে সেটা অন্যায়, যতোই আমি বলি না কেন আমার রাগ উঠে গিয়েছিল, আমার মাথা ঠিক ছিল না। একটা অন্যায় কে সবসময় জাস্টিফাই করা হলে তখন ধীরে ধীরে সেটা নিয়মে পরিণত হয়, বাংলাদেশের ঘুষ, দুর্নীতি হলো উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

অবশ্যই সিচুয়েশন অনেক রকম হইতে পারে কিন্তু তাই বলে একটা অন্যায় তো আর ঠিক কাজ হয়ে যায় না, হয়তো পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাকে মাফ করে দেওয়া যায় বা শাস্তি কম দেওয়া যায়। যেমনটা বাংলা সিনেমায় দিতো, নায়ক ভিলেন কে মেরে ফেলছে তাই ফাঁসি না দিয়ে কয়েক বছর কারাদণ্ড দিতো।

এখন বলতে পারেন যে এইসব ন্যায় অন্যায় তো আমাদের সুবিধামত ঠিক করা, প্রচলিত নিয়ম কানুন আমরা মানি না! জ্বী, আমরা মানতে না-ই পারি, আমি নিজেও বেশ কিছু জিনিস মানি না কিন্তু এর অর্থ এই না যে আমি আরেকজনের উপর জুলুম করতে পারব? আরেকজনকে ঠকাতে পারব, প্রতারণা করে পার পেয়ে যাবো?!

ফিরে আসি, পরকীয়া ইস্যু তে, পরকীয়া কেন অন্যায় বা জুলুম সেটা বলছি এক্ষণ। যখন আপনি একটি সম্পর্কে থাকবেন সেখানে আমরা বিশ্বাস, দায়বদ্ধতা ও যত্নের উপর আস্থা রেখেই সম্পর্কে যাই, কিন্তু আপনি যখন পরকীয়া করছেন তখন আপনি সেগুলো ভেঙে ফেলছেন, সবথেকে বড় কথা হলো আপনার পার্টনারকে এই বিষয়ে ন্যূনতম ধারণাও দিচ্ছেন না। যখন সে জানতে পারে তখন তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এখন একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ আপনি আরেকটা অন্যায় দিয়ে করতে পারেন না, যদি করেন তাহলে সম্পর্কটা শেষ করার যে গ্রাউন্ড টা ছিল আপনার সেটা দুর্বল হয়ে যায় সমাজের চোখে, এর থেকে ভালো হয় যদি আপনি সম্পর্ক টা শেষ করে দিয়ে বের হয়ে আসেন আগেই, তাহলে দুপক্ষই শান্তিতে মন খারাপ করা গান শুনতে পারবেন। কিন্তু আপনি এই টক্সিক সম্পর্ক/ম্যারিড লাইফ থেকে বের হবেন না, কেন হবেন না সেটা নিচেই ব্যাখ্যা করছি।

অর্থাৎ এখন আলোচনায় আসলাম আমরা কেন পরকীয়া করি সে বিষয়ে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ হলো নিম্নলিখিত কারণগুলোর জন্যে মূলত আমরা পরকীয়া সম্পর্কে জড়াই।

১. নিজের ও সঙ্গীর চাওয়া-পাওয়াকে না বোঝা: এইখানে চাওয়া-পাওয়া বলতে শুধু ভাত কাপড় আর ট্যুর রেস্টুরেন্ট বোঝায় নাই। এইখানে চাওয়া-পাওয়া বলতে আমাদের অবচেতন মনে থাকা বস্তুগত জিনিসের বাইরে যে কমফোর্টগুলো চাই সেগুলোর প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। প্রতিটা মানুষ জন্মের পর থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পথে যে Need গুলো নিয়ে বড় হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Security, Belongingness, Caring, Physical Touch, Love, Attachment ইত্যাদি। এই চাহিদাগুলো বিভিন্ন সময়ের বাবা মা বা কাছের মানুষদের আচরণের কারণে বিভিন্ন আকার ধারণ করে। কারও মাঝে এইগুলো ফুলফিল হয়, কারও মাঝে ঘাটতি থাকে। সেই সাথে ইমোশনাল ও চিন্তাগত নানা দিক রয়েছে যা আমাদের অচেতন বা অবচেতন মনে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে। নিজের ও সঙ্গীর চাওয়া গুলো তে ভিন্নতা থাকতে পারে, সেগুলো কে চিহ্নিত করা এবং কোন প্রকার বিচার না করে বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। ভিন্ন চাওয়া গুলো মেনে নিতে পারছি কিনা সেটা খেয়াল করা। সেই সাথে কোন ধরনের আচরণ ও কাজ থেকে এই চাওয়াগুলো পূরণ হবে সেটা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় সম্পর্কগুলো তে ভুল বুঝাবুঝি প্রকট আকার ধারণ করে। এই জন্যে অনেকেই বলেন যে আমি ওর জন্য সব কিছু করলাম তবুও তাকে খুশি করতে পারি নাই।

২. নিরপেক্ষ না থেকে চাওয়া-পাওয়াগুলোকে জাজ করা: আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের মৌলিক চাওয়াগুলো কে নিজেদের অজান্তেই জাজ করি। ফলে আমরা ক্রমাগত আমাদের চাওয়াগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করি, এবং আমাদের আচরণ থেকে আমরা সন্তুষ্টি খুজে পাই না। যেমন, আপনার সঙ্গী হয়তো চাইছে আপনি তাকে প্রতিবেলায় জিজ্ঞেস করবেন সে খেয়েছে কিনা। এই চাওয়াটা র মাধ্যমে মূলত সে অনুভব করতে চায় যে আপনি তার প্রতি কেয়ারিং। আপনার কাছে মনে হতে পারে এইটা খুবই ক্লিশে, এখন কি শাবানা আলমগীরের যুগ আছে যে এইসব জিজ্ঞেস করতে হবে! এই জায়গাটায় আপনি সঙ্গীর চাওয়াটা কে জাজ করছেন। একই ঘটনা অন্যকোন ক্ষেত্রে আপনার সাথেও ঘটতে পারে। যেমন আপনি চাচ্ছেন খুব স্ট্রেস্ফুল সময়ে সঙ্গী আপনাকে জড়িয়ে ধরুক, এতে আপনি সিকিউর ও ভরসার জায়গা অনুভব করবেন। কিন্তু আপনার সঙ্গী যদি জাজ করে যে কিসব বাচ্চাদের মত অ্যাটেনশন চাচ্ছো তখন আপনার কেমন লাগবে?!

এইবার আসি নিজের মনের মধ্যে চলা জাজমেন্ট সম্পর্কে, আপনি হয়তো চাচ্ছেন আপনার সঙ্গী আপনাকে জড়িয়ে ধরে হাগ করুক, এতে আপনার ভালোবাসার (আনন্দ, উচ্ছ্বাস, নিরাপত্তা) অনুভূতি হবে। কিন্তু আপনি লজ্জায় বলতে পারছেন না, কারণ আপনি নিজেকে জাজ করছেন এইভাবে যে, এইটা বলা ঠিক হবে না, পার্টনার আমাকে নির্লজ্জ ভাবতে পারে।

এইভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের ও অন্যের চাওয়াগুলোকে জাজ করছি, ফলে সঠিক ভাবে একজন আরেকজনের চাওয়া বুঝতে পারছি না বা বুঝার চেষ্টা করছি না। এই না বুঝার মানসিকতার সাথে যুক্ত হয় আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যা সম্পর্কগুলো কে ধীরে ধীরে নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

৩. নিজের ও সঙ্গীর অনুভূতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা: আমরা অনেকই জানি না আমাদের মধ্যে এক্সাকটলি কি অনুভূতি হচ্ছে। কেননা আমরা কখনোই সেটার প্রতি আলাদা মনোযোগ দেই না, আমরা যেইটা করি সেটা হলো আমরা আমাদের চিন্তাগুলোর উপর এত বেশি মনোযোগ দেই যে অনুভূতিগুলো রয়ে যায় অন্তরালে। ফলে এই অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে আমাদের অবচেতন ও অচেতন মনে চেপে বসে যা পরবর্তীকালে আমাদের চিন্তা, ধারণা ও বিশ্বাস কে প্রভাবিত করছে। আর এই চিন্তা, ধারণা ও বিশ্বাসগুলো দেখা যায় নানা রকম নেতিবাচক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে।

আমরা যদি আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিগুলো কে আলাদা করতে শিখি এবং সহমর্মিতার সাথে বোঝার চেষ্টা করি তবে অধিকাংশ ঝামেলা বা জটিলতা তৈরিই হবে না। বিশেষ করে ভুল বুঝাবুঝি সংক্রান্ত বহু সমস্যা গোড়াতেই সমাধান হয়ে যাবে। নিজের ও সঙ্গীর অনুভূতিগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সহমর্মী হওয়া যেকোন ভালো সুস্থ সম্পর্কের পূর্বশর্ত।

কুইজ: আমরা কে কয়টি অনুভূতির নাম জানি? বাংলায় ও ইংলিশে? উত্তর কমেন্টে দেওয়া আছে।

৪. হেলদি কমিউনিকেশন বা সঠিক যোগাযোগ পদ্ধতি না জানা: ছোটবেলা থেকেই আমরা নিজেদের যোগাযোগ দক্ষতা নিয়ে খুব একটা কাজ করি না। যে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে বসবাস করি সেখান থেকে অবচেতন ভাবেই যা শিখি সেগুলোই প্রয়োগ করি যা বর্তমান সম্পর্কগুলোতে আরো জটিলতা তৈরি করছে যা পরবর্তীতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে নিয়ে যায় আমাদের কে। আমরা সবাই কর্পোরেট বা গতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় শিখে নিয়েছি কিভাবে কার্যকর উপায়ে দ্রুত যোগাযোগ করতে হয়। কিন্তু গতিশীলতার মাঝে যে বিষয়টি আমরা উপেক্ষা করে গিয়েছি সেটি হলো সাইকোলজিক্যাল কমিউনিকেশন বা কানেকশন কিভাবে তৈরি করতে হয়। মনের কথা বলার জন্য এখন আর চোখে চোখ রাখলেই চলে না, কথাও বলতে হয়। কিন্তু কিভাবে বলবো এই কথা? আমি এই জন্য সব সময় বলি নিজের গ্রাউন্ড টা ধরে রেখে assertive communication এবং Nonviolent Communication (NVC) প্রয়োগ করার জন্য। NVC এর মৌলিক যে চারটা স্টেপ আছে সেটা ফলো করে আমরা যে কারো সাথে সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারি। বিশেষ করে কাছের মানুষ ও পার্টনার এর সাথে যোগাযোগ করার আদর্শ মাধ্যম হলো NVC. যে চারটি স্টেপের কথা বলছি সেগুলো হলো

৪.১. পর্যবেক্ষণ: কোন প্রকার জাজ না করে পর্যবেক্ষণ করে ফ্যাক্ট বেজড ইস্যুগুলো তুলে আনা। যেমন তুমি সবসময়ই আমাকে ইগনোর কর। এইটা একটা জাজমেন্ট। কিন্তু আপনি যদি বলেন তুমি আজ সকাল থেকে আমাকে ইগনোর করছো, আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না। তখ। হবে সেটা সঠিক পর্যবেক্ষণ।

৪.২. অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সহমর্মী হওয়া: নিজের ও সঙ্গীর অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সহমর্মী হওয়া জরুরি। যেমন, তুমি সকাল থেকে আমাকে ইগনোর করছো, আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না। এতে আমার কষ্ট লাগছে, তুমি কি আমার উপর বিরক্ত?

এইখানে নিজের অনুভূতি যেমন প্রকাশ করছি তেমনি সঙ্গীর অনুভূতিকেও বুঝার চেষ্টা করছি।

৪.৩. নিজের ও সঙ্গীর চাওয়া কে প্রকাশ করা: তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমার কষ্ট হয়, তুমি যদি উত্তর দাও তাহলে আমি নিরাপদ বোধ করবো, নিশ্চিন্ত হবো, তুমিও পরিষ্কার ধারণা পাবে আমার মধ্যে কি চলছে। এইখানেও নিজের চাওয়া টা স্পষ্ট করে জানান দেওয়া হলো সেই সাথে সঙ্গীর চাওয়া কেও যুক্ত করা হলো।

৪.৪. অনুরোধ করা বা পদক্ষেপ নেওয়া: সর্বশেষ ধাপ হলো অনুরোধ করা, অর্থাৎ সঙ্গীকে অনুরোধ করা পদক্ষেপ নিতে। যেমন, তুমি কি আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে? এই অনুরোধ করার মাধ্যমে মূলত সঙ্গীকে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা হলো।

পুরো উদাহরণটি এমন: আমি খেয়াল করছি আজকে সকাল থেকে তুমি আমাকে ইগনোর করছো, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছো না ও আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না। এতে আমি কষ্ট পাচ্ছি, তুমি যে বিরক্ত হয়ে ইগনোর করছো সেটাও বুঝতে পারছি। তুমি যদি একটু কথা বলো/মনোযোগ দাও তাহলে আমি একটু নিরাপদ বোধ করবো এবং কানেকটেড ফিল করবো। সেই সাথে তুমিও পরিষ্কার ধারণা পাবে কি চলছে আমার মাঝে। তুমি কি আমার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনবে?

NVC প্রয়োগ করে যেকোন ক্রাইসিসে যোগাযোগ অনেক সহজ করে ফেলা যায় এবং মার্শাল রোজেনবার্গ বলেছেন যে NVC হলো অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দেওয়া এবং সহমর্মিতার সাথে গ্রহণ করা। সুতরাং অনুভূতির গুরুত্ব এইখানে সহজেই অনুমেয়, বিশেষ করলে যেকোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে। একটি সঠিক যোগাযোগ পদ্ধতি আমাদের সম্পর্কগুলোকে বাঁচিয়ে দিতে পারে এবং সেই সাথে গড়ে তুলতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক ও নিরাপদ সম্পর্ক।

৫. দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র্য না আনা বা কোয়ালিটি টাইম না থাকা: যেকোন সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অন্যতম মূলমন্ত্র হচ্ছে বৈচিত্র্যময়তা ও ভালো সময় কাটানো। বর্তমান এই পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্টিমুলাস আসছে আমাদের জীবনে। সেখানে যদি সম্পর্কগুলোতে এক ঘেয়েমি চলে আসলে আমরা ধীরে ধীরে আগ্রহ হারাতে থাকি। কারণ আমরা সব সময় এমন কিছু চাই যা আমাদের একই সাথে এক্সাইট করবে কিন্তু আমার জন্যেই থাকবে। দুইজন রোমান্টিক পার্টনারের জীবনে এমন এক্সাইটমেন্ট ও ভালোলাগার অনুভূতিগুলো নিয়ে আসা খুবই জরুরি, এর জন্যে নিজেদের কে ভালো করে বুঝতে হয় এবং যেসকল কর্মকাণ্ড মিউচ্যুয়াল হবে সেগুলোর চর্চা করতে হবে।

যেমন: একটি ট্যুর হতে পারে সম্পর্কের নতুন একটি মাত্রা। সেটা হতে পারে ট্রেকিং অথবা একদিন এর রিলাক্স ট্যুর, যেটাই হোক না কেন সম্পর্ককে নতুন ভাবে দেখতে সাহায্য করবে। তেমনি হতে পারে কোন সিনেমা বা সিরিজ দেখা, বই পড়া, এক সাথে কিছু রান্না করা ইত্যাদি। আমাদের চাওয়া অনুযায়ী এই বৈচিত্র্যময় কাজ গুলো না আসলে একটি সম্পর্কে তখন প্রবেশ করে নতুন কেউ যাকে নিয়ে আরো বেশি এক্সাইটমেন্ট কাজ করে না, কেননা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ একটু বেশিই কাজ করে। আসলে বৈচিত্র্যময় করার কথা না বলে কোয়ালিটি টাইম এর কথা বলা এইখানে বেশি রিলেভেন্ট।

আর যদি এই বৈচিত্র্যময়তার বা কোয়ালিটি টাইমের ঘাটতি দেখা দিবে তখন পরিণতি টা আশানুরূপ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। হতে পারে সেটা পরকীয়া বা ডিভোর্স কিংবা টক্সিক অভ্যাসে বন্দী দাম্পত্য জীবন।

আমি পরকীয়া ভালো মনে করি না বলে একটা টক্সিক সম্পর্কে সারাজীবন থাকবো এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। এইখানে এই আলোচনাটাই করা হয়েছে, টক্সিক রিলেশনশিপ থেকে কিভাবে বের হয়ে আসতে হবে, এর জন্যে নিজেকে ও পার্টনার কে বুঝতে হবে যাতে টক্সিক হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কখন বুঝবে টক্সিক সেটার জন্যেই শেষের অংশটুকুতে পর্যবেক্ষণ, অনুভূতি ও নীডস গুলো নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

নিজের চাওয়া পাওয়াগুলো কে বুঝার চেষ্টা করুন, কোন প্রকার জাজ না করে অনুভূতিগুলো কে মেনে নেওয়ার চর্চা করুন এবং সেই সাথে সম্পর্কগুলোর মাঝে সঠিক ভাবে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, একটি সঠিক যোগাযোগ আমাদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি থেকে দূরে রাখতে পারে।

ভিন্নমত থাকতে পারে, পরকীয়া নিয়ে আপনার ভাবনা ও মন্তব্য শেয়ার করতে পারেন নির্দ্বিধায়।

ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।

বিনীত

ফয়সাল আহমেদ রাফি ফাউন্ডার এন্ড চিফ সাইকোলজিস্ট ফয়সাল

রাফি এন্ড এসোসিয়েটস

Image
Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco

Sinead Bailey

Volunteer
I greatly appreciate Faysal Rafi Bhaia's support during my hardest time. I took his sessions after trying with couple more psychologists and found his ones so helpful for me. Bhaia is always very important for counseling. He listened to everything I had to tell him. And he would suggest me something which was doable and wouldn't create much pressure on me. One more thing I want to add which I liked about his counseling that he went over my background, from the very beginning of my life, for understanding me better. To my understanding every patient is different and this is very important to know where they have come from and what thry have gone through in their past. He tried to know me first and after listening a lot from me he suggested me some solitions those perfectly worked for me. I absolutely loved the way he handeled my situation. I will be indebted to him for keeping me calm and patient during my most hard time of life. I wish him all the best with his career and all his future endeavours.

Azbina Rahman Oni

Client
আমি ভাইয়ার কাছে কখনো কাউন্সিলিং করিনি, তবে মনের স্কুলের মাধ্যমে রাফি ভাইয়ার ট্রেনিং এর ওয়ার্কশপ অংশগ্রহণ করার সুযোগ যেমন পেয়েছি, তেমনি এগুলো ভাইয়ার সাথে আয়োজন করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তিনি কেবলমাত্র একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে না, মানুষ হিসেবেও অসাধারণ। আমার কাছে কেউ কাউন্সেলর রিকমান্ডেশন চাইলে প্রথমেই "ফয়সাল রাফি" নামটা আসে। বাংলদেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে আপনার মত আরো অনেক মানুষ দরকার আমাদের।

Fairooz Faizah Beether

Client
রাফি ভাইয়ার সাথে প্রথম যেদিন পরিচয় হয়েছিল, ওইদিন থেকে আজ পর্যন্ত মনের স্কুলের এবং আমাদের টিমকে কতটা সাপোর্ট দিয়েছে সেটা অতুলনীয়। কাজের পাশাপাশি রাফি ভাই মানুষ হিসেবেও একজন মনের মানুষ, সব ধরনের সাপোর্ট পেয়েছি ভাইয়ার থেকে পুরোটা সময়। মনের স্কুল সবসময় রাফি ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া সবসময় এভাবে মনের স্কুলের পাশে থাকার জন্য।

Arif Islam

Client
আমি মানসুরা, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। হারিয়ে ফেললে ভুল হবে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না নিজেকে আসলে। এখন ফিরিয়েছি নিজেকে, নতুন করে নিজের সাথে পরিচয় করিয়ে, যায় পুরো ক্রেডিট আমি ফয়সাল রাফিকে দিবো। হারিয়ে ফেলা ১০ টি বছর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমনকি শিখিয়েছেন সব কিছুর মধ্যে ভালো থাকার কৌশল। তার চিন্তা ভাবনার কাছে আমার সমস্যাগুলো, কষ্টগুলো অদ্ভুত সুন্দর। কষ্ট বলতে আসলে কিছুই নেই। প্রতিনিয়ত নিজেকে মেরে ফেলতে চাওয়া মানুষটাকে শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন জীবনের বেচেঁ থাকার উদ্দেশ্য। শিখিয়েছেন কঠিন পথগুলো কতটা সুন্দর মানিয়ে নিলে, হাজারো মানুষের ভীড়ে কতটা সুন্দর "বেচেঁ থাকাটা আমি" ধন্যবাদ রাফি স্যার, আমার নিজেকে গুছাতে হেল্প করার জন্যে।

Mansura Islam

Client
I've taken both individual and couple therapy with Faysal Rafi Bhaiya. This experience has changed my thinking ability and pattern for good. He's been very kind and attentive during the sessions. He has a personality where I had no problems sharing everything of my life. I would say, he has a great listening skill, which is a rare quality. Rafi bhaiya has gone through all parts of my life in details, remembering even small things I ever said, to find out the patterns and traumas in my life, which definitely made me so comfortable during the sessions. I would say this experience made me confident to overcome my problems, to understand and accept situation better than ever. I had and will recommend Faysal Rafi to my peers as a dependable psychologist in Dhaka. I wish him all the best.

Progga Paromita

Client

    WE PROVIDE

    Complete Mental Health Care For You And Your Loved Ones
    Faysal Rafi & Associates established with the aim of providing capacity building programs, trainings and consultations for mental health wellbeing of youth. Our programs are person centered, evidence based and solution focused, so that it can have maximum utilization of organization’s resources